স্টাফ রিপোর্টার : লন্ডনে আলোচিত ড. ইউনুস-তারেক বৈঠকের পর অনেকটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের চলমান উত্তাপ হয়ত আপতত ছাই চাপা পড়ল। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। গত ১৩ জুনের ওই বৈঠকের পর পেরিয়ে গেছে ১৬ দিন। এই সময়ে পদ্মা-মেঘনা দিয়ে যেমন অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে, তেমনি রাজনীতির সমীকরণও অনেক বদলে গেছে। গত ২৮ জুনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশের পর রাজনৈতিক অনৈক্য এখন তুঙ্গে। বিশ্লেষকদের অনেকেই একে বিএনপির বিপরীতে ইসলামী দলগুলির শক্তিমত্তা প্রদর্শনের এক বড় রকমের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। সমাবেশের পরদিন বিএনপি নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় আগের দিনের সমাবেশকে কিভাবে দেখছেন, তার একটা মূল্যায়ন পাওয়া গেছে। দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মির্জা আব্বাস তাঁর বক্তব্যে বলেছেন যে, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি যে দাবি করেছে তা আদায় করে নেওয়ার শক্তি তাদের রয়েছে। তিনি বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার জন্য মূলত জামায়াতকে ইঙ্গিত করে তীর্যক মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। লন্ডন বৈঠকের পর নতুন করে রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর) করার দাবিকে ঘিরে। জামায়াত-এনসিপিসহ ইসলামী দলগুলির অধিকাংশ চায় এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হোক। অন্যদিকে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে অনড়। বিএনপি পিআর পদ্ধতিতেকে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবেও অভিহিত করেছে। বিএনপি নেতারা এও দাবি করছেন যে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যে সারমর্ম দাঁড়াচ্ছে, তাতে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে দেওয়া হয়েছে। সমাবেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার গ্যারান্টি কে দিয়েছে-এমন প্রশ্নও তুলেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ কোনও দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজকে ক্ষমতায় যেতে দেবে না। একটি সর্বদলীয় সংসদ গঠন করতে পিআর হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। বিএনপিরও তা মেনে নেওয়া উচিত।’
আলোচিত এই সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল এনসিপির সদস্য সচিব মুহাম্মদ আখতার হোসাইন ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ছাড়াও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিও যথেষ্ঠ পরিমাণে দেখা গেছে।অন্যদিকে, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দীন, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানি, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মূসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজিও এতে অংশ নেন।অনেককে অবাক করে দিয়ে সমাবেশে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রর সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও’র উপস্থিতি রাজনীতিতে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ অন্য দলগুলির টানাপোড়েন নিয়ে গতকাল বলেছেন, ‘বিএনপি যত ছোট হওয়া দরকার, যত অবনত হওয়া দরকার হয়েছে, কিন্তু শেষমেষ রেজাল্টটা কি হয়েছে তা আমরা ২৮ তারিখে দেখেছি।যে মহাসমাবেশটি হল, এর কাউন্টার আরেকটা সমাবেশ বিএনপি করতে পারবে তা অনেকেই বিশ্বাস করে না। চেষ্টা করতে পারে বিএনপি, সফল হলে ভালো; তাতে রাজনীতি আরও সংঘাতময় হবে। আর যদি ব্যর্থ হয় তবে বিএনপির রাজনীতি শেষ’-বলেন রনি।আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি (প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদের আসন) ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা গত শনিবার আবারও প্রমাণিত হয়েছে। সেদিন একমঞ্চে ১০টি রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে বলেছেন, এই পদ্ধতিতে ভোট না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। বিএনপি এই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আরও কঠোর বার্তা দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। পিআর পদ্ধতি কই থেকে আসে? কে দেয় বুদ্ধি আপনাদের? এই সব কু পরামর্শ নিয়ে, এই দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক আজকে মাঠে নেমেছে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, তাহলে এই প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতি নিয়ে জনগণের কাছে গিয়ে ম্যান্ডেট চাইতে হবে। জনগণ ম্যান্ডেট দিলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এর জন্য প্রথমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। জনগণের ভোটে একটি সরকার গঠন করতে হবে।লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর রাজনৈতিক মহলে তখন আলোচনা উঠেছিল বিএনপির রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব কমেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামপন্থিদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর নেপথ্য ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। এরই অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনার পর অবশেষে গত শনিবার ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে একমঞ্চে উঠেছেন ওইসব দলের নেতারা। ওই মঞ্চ থেকে বক্তৃতাকালে সব দলের নেতাই বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় তাদের উদ্দেশ্য আছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যাপারে সবাই একমত। বিশ্বের ৬০-৬২টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে ভোট হয়। পিআর পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি, পেশিশক্তির ব্যবহার, কালো টাকার ব্যবহার এবং কেন্দ্র দখলের সুযোগ থাকবে না। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দলের এমপি নির্বাচিত হবেন। এখানে ব্যক্তি নয়, দলের স্বার্থ থাকে। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নীতিগতভাবে আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এখনই পিআর বাস্তবায়ন না করলেও চলতে পারে। বিএনপি কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন মানে, সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেবে এবি পার্টি। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েন ছাড়াও দ্বন্দ্ব রয়েছে জাতীয় নাকি স্থানীয় নির্বাচন, কোনটি আগে হবে তা নিয়েও। বিএনপি বরাবরই স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, ইসলামী ও ছোট দলগুলি চায় স্থানীয় নির্বাচন আগে হোক। কিন্তু এসব দাবির প্রশ্নে দ্বন্দ্ব যত জোরাল হচ্ছে-ততোই অনিশ্চয়তা বাড়ছে নির্বাচন নিয়ে। ডিসেম্বর নাকি ফেব্রুয়ারিতে- না এর কোনটিতেই নয়, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যদিকে, প্রকাশ্য রাজনীতিতে না থাকা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল তাঁর সাম্প্রতিকতম এক বিশ্লেষণে জোর দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর, তা আপনি মানেন কিংবা না মানেন। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও বর্তমান রাজনীতির দুই মেরুর নেতৃত্বে থাকা বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই আওয়ামী লীগের ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে মরিয়া বলেও মন্তব্য এই বিশ্লেষকের। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে দিনগুলি যে মোটেও শান্ত থাকবে না তা অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর গন্তব্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখতে আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
Posted ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta